১৮৬২ সাল। উসমানীয় খিলাফতের অধীনস্ত আফ্রিকার একটি ছোট শহরের এক দরিদ্র পরিবারে নতুন একটি শিশুর জন্ম হয়। ১৬ বছর বয়সে ছেলেটির বাবা মারা গেলে শহরের একজন শিক্ষক তাকে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসেন।
এই সময়ই ধীরে ধীরে তিনি এমন একটি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে, রাতে মাত্র ৩ ঘণ্টা ঘুমাতেন। রাতের শেষ ভাগে উঠে প্রভুর সান্নিধ্যে সালাতে দাঁড়াতেন। ফজরের পূর্বের বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিতেন কুরআন তিলাওয়াতে। এ সময় তিনি কুরআন হিফজ সম্পন্ন করে ফেলেন। প্রতি সাতদিনে একবার সম্পূর্ণ কুরআন পড়ে শেষ করতেন। পরবর্তী জীবনের শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও এই অভ্যাস তিনি ত্যাগ করেননি।
অল্প বয়সেই তার সাহস আর প্রজ্ঞার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের কাছেই তিনি হয়ে ওঠেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে। এক কাফেলার সাথে সুদান যাওয়ার পথে একটি ঘটনায় তার সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। যাত্রাপথের একটি সরু রাস্তা রোধ করে একটি বিরাট সিংহ দাঁড়িয়েছিল। কাফেলার সবাই আতংকিত হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সকলেই। অবশেষে সবাই মিলে ঠিক করলো যে, সিংহটিকে একটি উট দেয়া হবে; যাতে উটটি নিয়ে সে তাদের পথ ছেড়ে চলে যায়। এই অবস্থায় তিনিই তার করণীয় ঠিক করে নেন। তিনি তার শট গানটি নিয়ে ঘোড়ার উপর চড়ে বসলেন এবং সিংহটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সবার চোখ কপালে উঠে গেল, কিছুক্ষণ পর তিনি সিংহটির মাথা নিয়ে ফিরে এলেন! তার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাকে উপাধি দেয় “সিয়েরানিকার সিংহ”।
তার চরিত্র গঠনে সাহস এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তার চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য শুধু তার নিজের গোত্র, দেশ আর মানুষেরই নয়; বরং ঔপনিবেশিক পরবর্তী যুগে সারা পৃথিবীর মুসলিমদের ভাগ্য পরিবর্তনে অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে ওঠে।
মাত্র বিশ বছর বয়সেই তিনি বেশ বিচক্ষণ ও পরিপক্ক হয়ে ওঠেন। ফলে এই বয়সেই গোত্রের নানা সমস্যা সমাধানে তার ডাক পড়তো। লোকেরা তার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতো এবং গ্রামের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই হোক কিংবা ধর্মীয়, তার পরামর্শ সবাই সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিতো। তার শিষ্টাচার ছিল সুবিদিত। তার ভাষার প্রাঞ্জলতা সহজেই সবার মনোযোগ কেড়ে নিতো। এই বৈশিষ্টগুলোই পরবর্তীতে ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে তাকে সাহায্য করেছিল।
তার বয়স যখন ত্রিশের কোঠা অতিক্রম করছে, তখনই পৃথিবীজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ঔপনিবেশিকতার রোগ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। একের পর এক দেশ যখন ইউরোপিয়ানদের হাতে বেদখল হচ্ছিলো, তিনি তার এলাকায় ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রাখেন। ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। বনু সানুস গোত্রের সাথে জোট বেঁধে তিনি প্রথমে ফ্রেঞ্চ এবং পরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। কারণ তারা এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল।
ইউরোপিয়ানদের দৃষ্টিতে অনুন্নত জাতিগুলোকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করার এই প্রতিযোগিতায় ইতালিও যোগ দেয়। উত্তর আফ্রিকায় তার অভিযান শুরু করে। কিন্তু লিবিয়া দখলের যাত্রাপথেই পঞ্চাশ বছর বয়স্ক এই মানুষটি তাদের সামনে পাহাড়ের মত বাধা হয়ে দাঁড়ান।
সংঘর্ষ এড়াতে ইতালিয়ানরা তাকে উচ্চ পদ এবং সম্পদের লোভ দেখায়। বিনিময়ে তাকে আত্মসমর্পণ করে তাদের আনুগত্য মেনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। এর জবাবে তিনি তার বিখ্যাত উক্তিটি করেন, “আমি কোন মজাদার খাবার নই যে, কেউ চাইলেই আমাকে গিলে ফেলবে। তারা আমার আদর্শ-বিশ্বাসকে টলাতে যতই অপচেষ্টা করুক, আল্লাহ তাদের পরাজিত করেই ছাড়বেন।”
তারা হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে যায়। পরবর্তী অভিযানের শুরুতে তাকে আবার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তিনি যদি তার এলাকা ছেড়ে তাদের কাছে চলে আসেন, তাহলে তিনি অর্থ-বিত্ত সহ বিলাসী জীবন যাপনের সকল সুবিধা পাবেন। কিন্তু তিনি আবার এই বলে প্রত্যাখ্যান করেন, “কখনোই না, আমার প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার আগে আমি কিছুতেই এই মাটি ত্যাগ করবো না। আমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই। আমি তো প্রতি মূহুর্তেই তার জন্য অপেক্ষা করে আছি।
বয়সের ভার তাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সত্তরোর্ধ এই মানুষটিই ছিলেন তার দেশের মানুষের আশার কেন্দ্রস্থল। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সমৃদ্ধ হাজার হাজার সৈন্য আর যুদ্ধবিমানের বিপরীতে তার ছিল কয়েকটি ঘোড়া, সাধারণ রাইফেলধারী কিছু লোক, যারা পাহাড়ে পাহাড়ে উপোস ঘুরে বেড়াচ্ছিল। উম্মাহর অন্যান্য সাহসী সেনাপতিদের মতোই, তার শক্ত অবস্থান আর তেজোদ্দীপ্ত কথায় লোকেরা তার পাশে জড়ো হতে থাকে। তিনি ইতালিয়ানদের দূর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করে তাতে আঘাত হানতে শুরু করেন। যারা ভেবেছিল, মুসলিম দেশগুলো দখল করতে কোন বেগই পেতে হবে না, তারা এবার প্রচণ্ড ধাক্কা খেল।